স্বদেশ ডেস্ক:
ভাড়ার টাকায় মেট্রোরেলের পরিচালন ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। তাই বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে মেট্রোরেল ঘিরে বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, যা ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) হাব নামে পরিচিত। মেট্রোরেল প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধনের প্রস্তাবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের এ পরিকল্পনা তুলে ধরেছিল বাস্তবায়নকারী সংস্থা ‘ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড’ (ডিএমটিসিএল)। তবে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ জানিয়ে দিয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠনের সময় টিওডি সংক্রান্ত ব্যয় বাদ দিতে হবে।
অবশ্য পৃথক প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পের আওতায় টিওডি কার্যক্রম বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। গত ৫ এপ্রিল এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে। বর্তমান ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের ওপর পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির দ্বিতীয় সভার সিদ্ধান্ত হয়, টিওডি বাদ দিয়ে ডিপিপি পুনর্গঠন করতে হবে। এর পর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ চিঠি দিয়ে জানায়, প্রকল্পের এ পর্যায়ে টিওডি যুক্ত করার সুযোগ নেই। তবে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং ভবিষ্যতে এমআরটি প্রকল্প লাভজনক করতে টিওডির তাৎপর্য রয়েছে। তাই জাইকা কিংবা এডিবির অর্থ সহায়তায় টিওডির ওপর একটি আলাদা কারিগরি প্রকল্প (টিএ) গ্রহণ করা যেতে পারে। এ জন্য পিডিপিপি এবং টিএপিপি মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে মেট্রোরেল বাস্তবায়নকারী কোম্পানি ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক আমাদের সময়কে বলেন, এমআরটি-৬ প্রকল্প থেকে বাদ পড়ছে। তবে রাজউক এ নিয়ে একটি নীতিমালা করছে। পরামর্শক, রাজউক ও ডিএমটিসিএল মিলে তৃতীয় পক্ষীয় একটি চুক্তিও হয়েছে। আমরা চাই মূল প্রকল্প থেকে এটি পৃথক হোক।
তিনি আরও জানান, প্রাথমিকভাবে দুটি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এর একটি উত্তরা সেন্টার; আরেকটি গাবতলী এলাকায়। গাবতলীতে হবে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যৌথ মালিকানায়। টিওডি নকশা ও সমীক্ষার প্রাথমিক কাজে ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা লাগতে পারে বলে ধারণা দেন সরকারের সাবেক এ সচিব।
সূত্র মতে, বর্তমানে এমআরটি-৬ উত্তরা থেকে মতিঝিল অংশের কাজ চলছে। অবশ্য মতিঝিলের সঙ্গে কমলাপুর যুক্ত করা হয় পরে। টিওডির বিষয়টি প্রকল্পের শুরুতে বিবেচনায় ছিল না। এখন টিওডি অন্তর্ভুক্ত করলে একদিকে প্রকল্পের খরচ বেড়ে যাবে, অন্যদিকে বাস্তবায়নকাল বাড়াতে হবে। প্রথম টিওডি হাব হবে উত্তরা স্টেশন সেন্টারকে ঘিরে। এ জন্য রাজউক থেকে জমি কেনা হয়েছে। দ্বিতীয় টিওডি হাব হবে গাবতলীতে। গাবতলী বাস টার্মিনালটি বর্তমানের জায়গা থেকে সরিয়ে নিতে চাইছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তবে মেট্রোরেল প্রকল্পের আওতায় এ জায়গায় টিওডি হাব করতে চায় ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, গাবতলী বাস টার্মিনালের জায়গায় টিওডি হাব হলে বর্তমানের অবকাঠামো ভেঙে ফেলার প্রয়োজন হবে না। এটির যৌথ মালিকানা থাকবে ডিএমটিসিএল ও সিটি করপোরেশন।
এদিকে মেট্রোরেলসহ অন্যান্য ট্রানজিট স্টেশনকেন্দ্রিক পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষে তিন বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে রাজউক। জাইকার অর্থায়নে ২০২৪ সালে প্রকল্পটি শেষ হবে। টিওডি সম্পর্কে রাজউক জানিয়েছে, এটি ঢাকা শহরের যানজট কমাতে ভ‚মিকা রাখবে। পথচারী ও পরিবেশবান্ধব মিশ্র ব্যবহার এবং উচ্চ জনঘনত্ব হবে টিওডি এলাকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
রাজউক আরও জানিয়েছে, সংস্থাটির খসড়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (২০১৬-৩৫) এমআরটি লাইন টিওডি বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এ জন্য এমআরটির (লাইন ১,৫ ও ৬) ১৫টি স্টেশন চিহ্নিত করা হয়েছে। মেট্রোরেল স্টেশনকেন্দ্রিক নতুন আবাসিক এলাকা তৈরি করতে চায় রাজউক। এতে করে নগরবাসীর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে। হাঁটা দূরত্বে স্টেশন থাকলে মানুষ সহজেই মেট্রো রেলে চড়ে গন্তব্যে যেতে পারবে।
এ নিয়ে মেট্রোরেল বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই নীতিমালা করছে রাজউক। নীতিমালার পর বাস্তবায়নের কাজটি করবে ডিএমটিসিএল। এ নিয়ে রাজউক চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘রাজউক প্রকল্পের মাধ্যমে মাস র্যাপিড ট্রানজিটসহ (এমআরটি) অন্যান্য ট্রানজিট স্টেশনকেন্দ্রিক পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি নীতিমালা তৈরি করবে। ভবিষ্যতে সব ট্রানজিট স্টেশনভিত্তিক উন্নয়নে গাইডলাইন হিসেবে কাজ করবে এটি। জমিস্বল্পতার কারণে মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশনকেন্দ্রিক টিওডি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। জাপানে টিওডি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল ১৯৬০ সালে। এখন এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। আমাদেরও এটি শুরু করতে হবে।’
এদিকে মেট্রোরেল প্রকল্প শুরুর এক দশক পর এসে বাড়তি আয়ের জন্য নতুন করে স্টেশন প্লাজা ও ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) করতে চায় ডিএমটিসিএল। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ জানতে চায়, আগের ডিপিপিতে কেন টিওডি এবং স্টেশন প্লাজার সংস্থান রাখা হয়নি। এর জবাবে ডিএমটিসিএল জানিয়েছে, ২০১১ সালের জাইকার প্রিপারেটরি স্টাডি রিপোর্টে বিষয়টি বাদ পড়ে। ওই জরিপে রাজউকের উত্তরা তৃতীয় আবাসিক প্রকল্পের ‘ডিজাইন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান’ চ‚ড়ান্ত ও নির্মাণ সময় নির্ধারণ করতে পারেনি। ২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাইকা মিশন থেকে ভাড়া ব্যতীত আয় বৃদ্ধির জন্য টিওডি হাবসহ অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। এরই ধারাবাহিকতায় পরে রাজউক থেকে ভ‚মি বরাদ্দ নেওয়া হয়।
এ ছাড়া ২০২০ সালের ৬ ফেব্রæয়ারি স্টেশন প্লাজার জন্য উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, পল্লবী, আগারগাঁও এবং ফার্মগেট মেট্রোস্টেশনকে স্টেশন প্লাজার জন্য নির্বাচন করে জাইকা। দাতাসংস্থাটি পরামর্শকের মাধ্যমে বিস্তারিত নকশা এবং চলমান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্টেশন প্লাজাগুলো নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। এ ছাড়া সাধারণ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টিওডি হাব নির্মাণে বেসিক ডিজাইনের প্রস্তাব করে জাইকা। মূল ডিপিপি ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রস্তুত করা হয় জাইকার এমওডির ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু একই এমওডিতে স্টেশন প্লাজা নির্মাণের বিষয়ে ভ‚মি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত তথ্য না থাকায় তা বাদ পড়ে। একইভাবে টিওডি হাবের বিষয়টি বাদ পড়ে সে সময়।